কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নে রয়েছে বড় জমিদার বাড়ি। তাঁর নাম রাজা শ্যাম রায়। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম হলো যার মনোহর আলী খান। স্মৃতির আয়নায় রয়েছে তাঁর জমিদার বাড়ি। নেই সেই জমিদার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জমিদার শায়েস্তা খান তার জমিদারির ২৫ শতাংশ দেওয়ান মনোহর আলী খানকে দান করেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁদের জমিদারি শুরু। একসময় তাঁদের জমিদারি হাতিয়া-নোয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। চট্টগ্রামের অধিকাংশ ছোট জমিদার ছিলেন এ পরিবারের তালুকি জমিদার।
তাঁরা বছরের বিশেষ দিনে মনোহর আলী খানের কাছে খাজনা নিয়ে আসতেন। খাজনা আদায়ের সময় (পুণ্যাহ) ভারতবর্ষের সেরা শিল্পী, বাদক দল এ বাড়িতে এসে মাতিয়ে রাখত। এর বাইরে সারা বছর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো।
রাজা শ্যাম রায়ের পরগণার নাম ছিল দেয়াঙ পরগণা। বর্তমানে এটি কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নে। এক সময় এ পরগণার ছিল সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। দেয়াঙ পরগণার পাশেই ছিল প্রাচীণ বন্দর। বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ যখন চট্টগ্রাম বিজয় করেন, তখন তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যাম রায়।
এক সময় মনোহর খানের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু হয়। তখন উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া অনেক কঠিন ছিল। তাঁর বিয়ে ঘিরেও রয়েছে বীরত্বের গল্প।জনশ্রুতি আছে, রাজা শ্যাম রায় মূলত চট্টগ্রামের রাউজানের মানুষ। নবাব শায়েস্তা খাঁ একদিন রাজার ক্ষমতা পরীক্ষা করার বুদ্ধি আঁটেন।
শায়েস্তা খাঁ বলেন, এক রাতের মধ্যে শ্যাম রায় যদি নবাবের বাড়ির সামনে একটি দিঘি খনন করে তাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম দেখাতে পারেন, তবে তিনি আনন্দিত হবেন। সকালে নবাব দেখেন সত্যি সত্যি তাঁর বাসস্থানের সামনে এক বিস্তীর্ণ দিঘিতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। কমলদহ দিঘি নামে সেটি আজও আছে চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে।
শ্যাম রায়ের এ কাজে মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজের মেয়েকে বিয়ে দেন। শ্যাম রায় তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ বিয়ের মধ্য দিয়ে নবাব পরিবারভুক্ত চট্টগ্রামের জমিদারির এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন মনোহর আলী খান ও তাঁর স্ত্রী। সেটা ১৬৬৬ সালের কথা। বর্তমানে জমিদার মনোহর আলী খানের ১৬তম বংশধর সাজ্জাদ আলী খান (মিঠু)। স্ব- পরিবারে থাকেন চট্টগ্রাম শহরে।
জানা যায়, ১৬৬৫ সাল থেকে এ পরিবারের জমিদারি শুরু হয়। দীর্ঘ কয়েক’শ বছর জমিদারি চলার পর ১৯৩০ সালে প্রজাতন্ত্র আইনের ভিত্তিতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে কমতে থাকে জমিদার বংশীয়দের শৌর্যবীর্য। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে পুরনো জমিদার বাড়ি। এক সময় বাড়ির পেছনে আরেকটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। জমিদারের বংশধররা গ্রামের বাড়িতে গেলে সেখানে বসবাস করেন। সেটিও এখন বসবাসের অনুপযোগী। পুরাতন ভবনটির কোনো সংস্কার না হওয়ায় তা পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে।
জানা যায়, জমিদার মনোহর আলী খানের অধস্তন সপ্তম পুরুষ ছিলেন ফাজিল খান। তিনি ফাজিল খাঁর হাটের প্রতিষ্ঠাতা। নবম পুরুষ ছিল ইলিয়াছ খান। মূল সড়কের পাশে ৩শ’ বছর পুরনো যে মসজিদ রয়েছে সেটির প্রতিষ্ঠাতা এ ইলিয়াছ খান।
বড়উঠান মূল সড়ক থেকে সরু রাস্তা ধরে যেতে হয় জমিদার বাড়ি। বাড়ির সামনে বিরাট দিঘি। এক পাশে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ধবধবে সাদা ইলিয়াছ খান মসজিদ। মূল কাঠামো অবিকৃত রেখে মসজিদটির সামনের দিকে সংস্কার হয়েছে।
মিয়াবাড়ির প্রবেশমুখে বড় একটি পুকুর। পুকুরটিতে দুটি ঘাট রয়েছে। একটি ঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় সংস্কার করা হয়।
পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রয়েছে মসজিদ। মসজিদের পাশের ঘাটটি এখনো অক্ষত। সেই আমলে নির্মিত মসজিদটির কারুকাজ চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে বিশাল বিশাল দেয়ালের ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও ঠান্ডা পরিবেশ মুসল্লিদের প্রশান্তি দেয়। মসজিদের পাশের কবরস্থানে যুগ-যুগ ধরে শুয়ে আছেন জমিদারের বংশধররা।
মূল বাড়ির সামনে রয়েছে লম্বা মাটির কাছারি। সামনে বড় বারান্দা। বারান্দায় দেয়া হয়েছে মাটির পিলার। কাছারির মাঝে রয়েছে মূল বাড়িতে যাওয়ার পথ। মূল বাড়িটি ঝোপঝাড়ে প্রায় আড়াল হয়ে গেছে। বাড়িটির আশপাশে অনেক দিনের পুরনো লিচুগাছ, বেলগাছসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ রয়েছে।
জানা যায়, জমিদার বাড়ির সামনের কাছারিতে মেহমানরা এসে বসতেন। সেখানে খাজনাও আদায় করা হতো। বিচার-আচারও হতো সেখানে। মাটির তৈরি কাছারিটির বিভিন্ন অংশ ক্ষয়ে গেছে। বাড়ির একপাশে ছিল ধানের বিশাল গোলা, অপর পাশে বিনোদন সান। প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বিতল ভবনটিতে ওপরে ও নিচে মোট ছয়টি কক্ষসহ দুই ফ্লোরে দুটি শৌচাগার ছিল।
এ বাড়ির ভবনে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তা চারকোণা আকৃতির। দেয়াঙ পাহাড়ের মাটি দিয়ে বিশেষভাবে ইটগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এর সাথে চুন-সুরকির মিশেলে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। জমিদারের বংশধররা ষাটের দশক থেকে ভবনটিতে বসবাস করা বন্ধ করে দেন।
স্থানীয়দের মতে, এক সময় পুরো বৃহত্তর চট্টগ্রাম জুড়ে ছিল এ পরিবারের নামডাক। কালক্রমে হারিয়ে গেছে সব জৌলুস। ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে পুরনো বাড়ির ভগ্নাংশ দাড়িয়ে থাকলেও সেটিও এখন বিলুপ্তির পথে। পুরনো ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে বাড়িটি সংস্কারের দাবি বড়উঠানের ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দিদারুর আলমের ।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post