এটা তামাশা না মগের মুল্লুক?
এই কথাটি মানতে রাজি নন সাংবাদিক মতি পাটোয়ারী। তিনি ফেসবুক ওয়ালে এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এটাকে তিনি তামাশা না মগের মুল্লুক বলেও উল্লেখ করেছেন। তার লেখাটি দেশতথ্য বাংলার সাহিত্য পাতায় হুবহু সংকলিত হলো।
বছর তিনেক ধরে লক্ষ্য করছি কবি নূরল হুদাকে জাতিসত্তার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। মনে করেছিলাম তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক,তাই স্তাবকরা তাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে পাহাড়ের চুড়ায় বসিয়ে দিচ্ছেন ।
এ মনিহার তার জন্য শোভনীয় নয়- এ কথা ভেবে কবি হয়ত বিব্রত কর অবস্থায় পড়েছেন। না, আমার এ ধারণা ভুল। তিনি জাতিসত্তার কবি, এটা তিনি ভালভাবে গ্রহণ করেছেন এবং জাবর কেটে কেটে তা উপভোগ করছেন।
বছর দুয়েক আগে এক বন্ধুর আহবানে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখেছি তিনি ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বসে আছেন। অনুষ্ঠানের লটকানো ব্যানারে তার নামের আগে জাতিসত্তার কবি লেখা রয়েছে।
আয়োজকদের না বলে দিলে তারা জাতিসত্তা’র কথাটি লিখতেন না।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বলছি, কাউকে ছোট করার জন্য বা হেয় করার অভিপ্রায় নিয়ে এ লেখাটি লিখছি না। আমি লিখছি বোধ ও উপলদ্ধি থেকে। কবি নূরল হুদা সমস্ত জাতিকে ধারণ করে আছেন তার সত্তার মধ্য দিয়ে। সেটা কি ভাবে সম্ভব হল?
সত্তা হল আত্নার পরিপূরক শব্দ। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক প্রবর ব্যরুস স্পিনোজার ব্যাখা দেওয়া দরকার থাকলেও সেদিকে আমি যেতে চাচ্ছি না। তবে এটুকু বলতে চাই, মাটি-মানুষ-পাখি-নদী-নৌকা-ধানক্ষেত-কাউনক্ষেত নিয়ে কবিতা লিখলে জাতিসত্তার কবি হওয়া যায় না।
তাই যদি হয় কবি জসীম উদ্দীনকে মহা জাতিসত্তার কবি বলা হত। তাকে কেন পল্লীকবি বলা হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় কবি গুরু এবং বিশ্বকবি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি। কবি নূরল হুদা এঁদের সবাইকে অতিক্রম করে বাঙালি জাতিরসত্তার বা আত্নার কবি বনে গেলেন! তা কোন প্রতিভার গুণে?
এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবিসি’র জরিপ অনুযায়ী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙিালি। শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার বন্ধু,তাই তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি বাঙালি জাতিসত্তার বা আত্না মানুষ হলেন না। হলেন কবি মুহম্মদ নূরল হুদা!
এটা আমার ব্যর্থতা কিনা,কবি নূরল হুদার কাব্য সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই। অর্থাৎ সেভাবে তার কবিতা আমার পড়া হয়নি। তার কাব্য প্রতিভা হয়ত অন্যদের আকর্ষণ করতে পারে। আমাকে করেনি। এ টুকু বলতে পারি তার কাব্যপ্রতিভা উত্তুঙ্গে হলে অবশ্যিই…..।
প্রতিভা তো অনেকটা স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। আমি তার কবিতা পত্রপত্রিকায় দেখেছি মাত্র। তার কোন কাব্যের নাম বলতে পারব না। কবি নূরল হুদার প্রায় সমসাময়িক কয়েকজন কবির নাম উল্লেখ করতে চাই। প্রথমে কবি নির্মলেন্দু গুণের কথা বলি।
তার ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’,কাব্যটি ছাত্রাবস্থায় বাল্যবন্ধু আব্দুল মতিনসহ ( পরে খাদ্য কর্মকর্তা) যৌথভাবে কিনে পড়েছি। তখন একার টাকা দিয়ে কাব্য কেনা সম্ভব ছিল না। বন্ধু চৌধুরী জাকারিয়ার (পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেরর) কাছ থেকে ‘না বিপ্লবী না প্রেমিক’ কাব্যটি নিয়ে পড়েছি। তা একা নয়, কয়েকজন মিলে তারুণ্যের ভাব নিয়ে পড়েছি।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ ইংরেজ কবি কোলরিজের ‘কুবলা খান’(কবির স্বপ্নে লেখা) কবিতাটির মত আমার কাছে প্রিয় এবং বহুবার পঠিত।
‘তবক দেওয়া পান’র কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে। অসম্ভবের যাত্রা’র কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা….. কবিতাটি আকর্ষণ করতে না পারলেও তার কবি প্রতিভা সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে।
এবার কবি মহাদেব সাহার কথা বলতে চাই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পর রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্র ‘পূর্বমেঘ’-এ তার একটি কবিতা পড়েছিলাম।
সে কবিতার একটি পংক্তি আজও ধারণ করে চলছি। কত হাজার বার যে অবচেতন মনে বিড় বিড় করে বলেছি সেই পংক্তি। আর কত হাজার বার যে পড়ব, তা বলতে পারব না। তার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার বিপ্লবী কবি খয়রিল আনোয়ারের কথা যোগ করছি।
মাস্টার্সে পড়ার সময় নিখিল সেনের লেখা ‘এশিয়ার সাহিত্য’ গ্রন্থে পড়া খয়রিল আনোয়ারের কবিতার একটি পংক্তি আমার মনের ভেতর গেথে আছে। এখনো মুছে যায়নি। এখনো বিড় বিড় করে আওড়াই। এখানে কবির সার্থকতা এবং প্রভাব।
জাতিসত্তার নামধারী কবি নূরল হুদা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে কহলীল জিব্রানের কথা বলতে হয়। কহলীল জিব্রানের কবিতায় সত্তা-আত্না বিষয়টা বেশি এসেছে বলে মনে হয়।
সেখানে কিন্তু জাতিসত্তা বিষয়টা আসেনি। ইংরেজি কাব্য জগতের পঞ্চ রোমন্ট্যিক কবিদের কবিতায় নানা ভাবে সত্তা-আত্নার কথা এসেছে নানা ভাবে। তা রোমান্ট্যিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিন, তিনি জাতীয় কবি। যদিও তিনি ডুয়েলে লড়ে অকালে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রচন্ড জীবনবাদী কবি একজন। তাকেও জাতিসত্তার কবি বলা হয় না। আর বাংলাদেশে একজন জাতিসত্তার কবির উদ্ভব ঘটল!
কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কবি মুহম্মদ নূরল হুদার সঙ্গে মতানৈক্যে কারণে আমি এসব লিখেছি। না,এ জন্য লেখা হয়নি। আমি তার পরিচিত কোন ব্যক্তি নই। কবিদের মধ্যে বিস্তর কাদা ছুড়াছুড়ি এবং লেখালিখি হয়। আমি কবি নই। আবার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার মেলামেশা নেই। তাই আমার সঙ্গে কারো মতানৈক্য নেই। তবে পত্রপত্রিকার দু’চার জন কবি-লেখক আমার সঙ্গে বেয়াদবি করলেও আমি ওসব গায়ে মাখিনি। এ লেখাাটি আমার একান্ত এবং বিবেক তাড়িত।
নিজের সীমা অতিক্রম করার মধ্যে যে মূঢ়তা থাকে সেটা জানিয়ে দিয়েছেন সারভানটিস। তার লেখা ‘ডন কুইকসোট’ উপন্যাসে। শেষে এ কথাটিই বলতে হল আর কী!
এবি//দৈনিক দেশতথ্য// নভেম্বর ১৭,২০২৩//

Discussion about this post