দৌলতপুর প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে জীর্ণশীর্ণ হাসপাতালকে নাস্তানাবুদ করার অভিযোগ খোদ হাসপাতালে নিযুক্ত আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
সরকারি একটি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষ এবং সেখানে কর্মরত কর্মীদের প্রায় সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখভালের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন একজন আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা। দায়িত্বের সফল বাস্তবায়নের জন্য এই কর্মকর্তার কাজের ধরণ এবং দৈনন্দিন চলাচলেও ভিন্ন নীতিমালা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের। কুষ্টিয়ায় জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামোতে ঠেলেঠুলে চলা দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘটছে উল্টো চিত্র। এক যুগ হলো কাজে যোগদানের পর থেকেই নিজস্ব হাসপাতাল নিয়েই ব্যাস্ত থাকেন এখানকার আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ছামসুল আরেফিন সুলভ। স্বয়ংক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করা, আর মাঝেমধ্যে নিজের চেম্বার অলংকৃত করা ছাড়া তিনি তেমন কিছুই করেন না বলে সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক অভিযোগ রয়েছে। তবে, অভিযোগ ও সত্যতা বরাবর মিললেও ডাক্তার ছামসুল আরেফিন দৌলতপুরের স্থানীয় হওয়ায় পুরো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিজের কব্জায় রাখতে তাকে বেগ পেতে হয়না। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই হাসপাতালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সরকার উন্নয়নের নানা উদ্যোগ হাতে নিলেও বারবারই তা বিফলে গেছে। প্রায় ৫শো বর্গ কিলোমিটার আয়তনের উপজেলা দৌলতপুরের ৭ লাখের বেশি মানুষের জন্য ৫০ শয্যার হাসপাতালের টুকিটাকি সেবা অপ্রতুল হলেও তারও সফল বাস্তবায়ন নেই। যদিও এর পিছনের অন্যতম কারণ জনবল আর যন্ত্রপাতির তীব্র সংকট। মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়েছেন আরএমও। এমন মন্তব্য দৌলতপুরের যত্রতত্র মানুষের।
খবর সংগ্রহে হাসপাতালে গেলে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও এখানে ১৮ থেকে ২০ জন চিকিৎসক ছিলো, এখন মাত্র ৪-৫ জন।হাসপাতালের নতুন ভবনে বহির্বিভাগে রোগী দেখার করিডোরেই বসার ঘর হাসপাতালটির আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ছামসুল আরেফিনের।
অনুসন্ধানের প্রথম দিন ঘরে ঢুকে কোনো চিকিৎসকই পাওয়া যায়নি, তবে ঘরে-বাইরে টিকেট হাতে সেবা প্রত্যাশী রোগীর ভিড় দেখা গেছে, দ্বিতীয় দিন দেখা গেছে তিনি ছিলেন-কিন্তু নেই! উপজেলার হোসেনাবাদ এলাকা থেকে আসা সবুজ আলী জানান, ৫ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর জানতে পারেন চিকিৎসক ছামসুল আরেফিন ভিতরে নেই, তিনি ছিলেন কিন্তু বাইরে গেছেন, গেছেন কিন্তু ঘণ্টার বেশি হলেও আসেননি,আসবেন কি-না তাও জানা নেই। আরেক অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করা হলে দেখা যায় আরএমও’র কক্ষে রোগী দেখেন অন্যকোনো ব্যক্তি, একেকদিন একেজনকেও দেখা গেছে। এমন দিন এই আবাসিক চিকিৎসকের দৌলতপুরের চাকুরী জীবনে দৈনন্দিন। স্ত্রীর মালিকানা সহযোগিতায় এখানে তিনি শুরু থেকেই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানেই রোগী দেখা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সময় দিতে হয় তাঁকে।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হওয়া স্থানীয় তরুণ সামি বলেন, খোদ কর্মকর্তারা স্থানীয় ছেলে তাদের সিন্ডিকেটই বড় সিন্ডিকেট। আরএমও নিজের চাকুরির দায়িত্বের চেয়ে তার ব্যবসাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এখানে তার নিজস্ব হাসপাতাল আছে তিনি সেখানেই ডিউটি করেন। নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট দিয়ে বাইরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালান। দৌলতপুরের স্বাস্থ্য সেবা তার (ছামসুল আরেফিনের) রামরাজত্ব বলেও মন্তব্য করেন এই তরুণ। হাসপাতালটির অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীও এসবে অতিষ্ট কিন্তু পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক।
স্থানীয় যুবক শরীফুল জানান, আওয়ামীলীগের সময় স্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদে নিজ এলাকায় বদলি পাওয়া কর্মকর্তারা এখানে দীর্ঘ সময় ধরে আছে। আরএমও যতদিন আছে, অতীতে এখানে কখনো কোনো কর্মকর্তা এত দীর্ঘ মেয়াদে থাকেনি।
স্থানীয় হওয়ায় জনসাধারণের কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করেনা, আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার বদলি ঠেকিয়েছেন তিনি। টিএইচও এবং আরএমও দুজনে এই এলাকারই ছেলে, অভ্যন্তরীণ গাফিলতির বিষয়ে আরএমওকে জবাবদিহিতায় রাখতে প্রধান কর্মকর্তা টিএইচও সক্ষম নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হাসপাতালটির খোদ টিকেট বিক্রেতা মোহাম্মদ সজীব জানান, ডাক্তার ছামসুল আরেফিনের অনুপস্থিতিতে অন্য ডাক্তারদের ওপর কাজের চাপ বেড়ে যায়, এমনিতেই চিকিৎসক কম, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় যুবক শুভ বলেন, আমরা অনেক বছর ধরে দেখছি আরএমও আধঘন্টা এক ঘণ্টার বেশি কখনোই হাসপাতালে থাকেন না। তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। হাসাতালের অভিভাবক যদি দায়িত্বহীন হয়, হাসপাতাল ভালো চলতে পারে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকটি বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছে, নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ডাক্তার ছামসুল আরেফিন, সেগুলো নিয়েই মূলত ব্যস্ত থাকেন তিনি। এছাড়া হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন টেন্ডারেও তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়মিত দেখা যায়।
হাসপাতাল প্রাঙ্গণের এক হকার মন্তব্য জানান, সুলভ স্যার (ছামসুল আরেফিন) হঠাৎ হঠাৎ আসে কিছুক্ষণ থাকে আবার চলে যায়। মাঝেমধ্যে কয়েকদিন আসেই না।৩০ কিলোমিটার দূর থেকে আসা নুরুন্নাহার সেবা না নিতে পেরে ফিরে যাচ্ছিলেন ক্ষোভের কথা বলতে-বলতে, জানা গেলো চিকিৎসা না পেয়ে এমন ফিরে যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়।আরএমও ছামসুল আরেফিন সুলভ বলেন, আমি সর্বোচ্চ রোগী দেখি, খোঁজ নেন। আমি কি ওখানে বসে থাকবো?হাসপাতালের এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তৌহিদুল হাসান তুহিন তুলে ধরেন নানা সংকটের কথা।
আরএমও’র দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গে বলেন, তাকে হাসপাতালের বাইরেও সরকারি অন্য জায়গায় অপারেশনের ডিউটি করতে হয় নিয়মিত। পাশাপাশি তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখেন। আমরা বায়োমেট্রিকে উপস্থিতি নিশ্চিত করি। কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোয়ার্টারে কেউ থাকেন না।অভিযোগ খতিয়ে দেখে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার নবাগত সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন।

Discussion about this post