মো.আলাউদ্দীন, হাটহাজারীঃ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশে চলা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কে সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ করায় আটক বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন প্রবাসীর সাথে সাজা হয়ে যাওয়া হাটহাজারী উপজেলার তিনজন মো. হারুন (৪৪), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪৩) এবং মেহেরাজ আহমেদ রাসেল (২৪) মুক্ত হয়ে শনিবার রাতে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
তাদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ায় স্ব স্ব স্বজনরা হ দেশে ফেরা প্রবাসীরা বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনুস কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারা পরিবারে ফিরে আসতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন ।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শনিবার রাতে আনুষ্ঠানিকতা শেষে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্ময়কারীদের দেয়া সংবর্ধনা শেষে প্রশাসনের সার্বিক সহযোগীতায় ওইদিন দিবাগত রাত আনুমানিক দুইটার দিকে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছান তারা।
রবিবার সকালে তাদের ফিরে আসার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধবরা তাদেরকে দেখার জন্য বাড়িতে ছুটে আসতে থাকে।
দেশে নিজ বাড়িতে ফিরে আসা হাটহাজারী উপজেলার ৩নং মির্জাপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডস্থ চতরপাড় এলাকার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের পুত্র মেহেরাজ উদ্দীন রাসেল জানান, সে আমিরাতের সারজা এলাকায় একটি হার্ডওয়ার দোকানে চাকুরি করতো। বিগত ৩ বছর পূর্বে সে আমিরাতে গেলেও গত ৭ মাস পূর্বে বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে পুনরায় তার কর্মস্থলে ফিরে যায় রাসেল। গত ১৯ জুলাই সে তার কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহতদের রক্তমাখা লাশ আর তৎকালীন সরকারের নির্দেশে নিরীহ ছাত্র সমাজের প্রতি নির্বিচারে গুলি বর্ষণের ভিডিও দেখে তারা বেশ কিছু বাংলাদেশী আরব আমিরাতে প্রবাসী রাস্তায় বিক্ষোভ করে। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসলে যে যার মতো নিরাপদ স্থানে ও বাসায় ফিরে যায়। তবে বিক্ষোভের ছবি আরব আমিরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পর্যায়ক্রমে ফোন করে সিআইডি অফিসে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে লকাপে ঢুকিয়ে দেয়। পরে তাদেরকে আবুদাবী হালু হাজতা কারাগারে নিয়ে গিয়ে আটক রাখে। এবং কোর্টের মাধ্যমে রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ করায় কারো দশ বছর আবার কারো ২৫:বছর পর্যন্ত সাজা হয়ে যায় তাদের। তবে তারা কেউই ভাবতেও পারেননি বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করলে আরব আমিরাতে তাদের এই করুন পরিনতি হবে। কিন্তু অন্তবর্তী কালীন সরকারের সহযোগীতায় তারা মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। সরকারের এই আন্তরিক সহযোগীতার জন্য সরকারের প্রতি দেশে ফেরা সকলেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
দেশে ফেরা আরেক প্রবাসী মো.হারুন (৪৪) সিআইডি পুলিশের হাতে আটক হবার ঘটনা বর্ননা করার সময় আবেগ আপ্লূত হয়ে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন। মো.হারুন উপজেলার ৮ নং মেখল ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নং ওয়াডস্থ রহমত কাজী বাড়ির মৃত শরীফ উদ্দিনের পুত্র। তার মো.জিহান (১৭), এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করা, এবং জেরিন আক্তার (১০), ও জান্নাতুল মাওয়া (০৮) নামের তিন সন্তান রয়েছে।
কথা বলার এক পর্যায়ে সে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলছিলেন গত ২৫ জুন প্রায় ২ মাস পূর্বে দেশে ছুটি কাটিয়ে পুনরায় নিজ কর্মস্থল আলাইনের সানাইয়া এলাকার ৩ নং গলিতে নিজ কাজে ফিরে যান। হারুন ওই এলাকায় ছোট খাটো ঠিকাদারি কাজ করতেন। ১৯ জুলাই মাগরিবের পর প্রবাসী কিছু বাংলাদেশীরা জড়ো হয়ে দেশে তখন চলমান বৈষম্য বিরুধী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে মিছিল করলে পুলিশ আসার সাথে সাথে সবাই যে যার মতো নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে। পরে রাত তিনটার দিকে হারুনের মোবাইলে আরব আমিরাতের সিআইডি পুলিশ ফোন করেন যা সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর দেখেন তিনি। পরে সকালে পুনরায় ফোনে রিং আসলে রিসিভ করার পর সিআইডি পরিচয় দিয়ে তাকে অফিসে যেতে বলেন। অফিসে গেলে নাম ঠিকানা জেনে তাকে বিদায় দিয়ে দেন এবং পরদিন ২১ জুলাই তাকে আবারো সিআইডি অফিসে যেতে বলে দেন। ২১ জুলাই অফিসে গেলে তাকে লকাপে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ । সেখানে গিয়ে একই অপরাধে আটক আরও বেশ কযেকজন বাংলাদেশীদের সাথে দেখা হয় তার। পরে আরব আমিরাতের আইন বিরোধী কাজ করার অপরাধে সে দেশের কোর্ট তাকে দশ বছরের সাজা দেন বলে জানতে পারেন। খবরটি শুনার পর সবাই জেলে কাঁন্নাকাটি করে নামাজ কালাম পড়ে সময় পার করছিলেন। এর মধ্যে এক সাওদী আরবের নাগরিক তার অপরাধের কারনে জেলে আসলে তার কাছ থেকে প্রথম দেশের সরকার পতনের খবর শুনি। এবং তার কাছ থেকে জানতে পারি সরকারের দায়িত্ব নেয়া অন্তবর্তী কালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনুস স্যার তাদের মুক্ত করার জন্য কাজ করছেন। ওই নাগরিক সেদিন বলেছিলেন আমরা সবাই খুব দ্রুত মুক্ত হয়ে যাবো। তার সেই কথাই সত্যি হয়েছে। আমাদের দেশের গর্ব ড.ইউনুস স্যার আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ। এই ঋণ আমি কখনই শোধ করতে পারবো না।
একই উপজেলার আরেক প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি সেদিন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ছিলেন, তিনি সরাসরি দেখেনওনি কিভাবে প্রবাসীরা আন্দোলন করেছে। তারপরও বিনা অপরাধে তাকেও ১০ বছরের সাজা দিয়েছিলো আরব আমিরাত সরকার। অনেক করে বুঝিয়েও তাদের সে কথা বিশ্বাস করাতে পারিনি। যদি ড. ইউনুস স্যার আমাদের মুক্ত না করতেন তবে আমাদের জীবন থেকে বিনা অপরাধে দশটি বছর হারিয়ে যেতো। বঞ্চিত হতাম পরিবার পরিজনের সাথে যোগাযোগ দেখা সাক্ষাতেরও। আল্লাহ ইউনুস স্যারের মঙ্গল করুন সে দোয়া করবো সারাজীবন। আর স্যারের কাছে অনুরোধ তিনি যেনো আমাদের পাসপোর্টের নো এন্ট্রি টা তুলে নিতে ব্যবস্থা নেন। তাহলে আমাদের যারা ব্যবসা বানিজ্য ফেলে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে তারা পুনরায় ওই দেশে গিয়ে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় ফিরে পাবো। দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারবো।
তারা তাদের মুক্ত করে নতুন জীবন দানকারী সরকার প্রধান ড.ইউনুস স্যারকে সামনে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ জানাতে চান বলেও জানান।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করে শাস্তি পাওয়া ৫৭ বাংলাদেশিকে সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হাটহাজারীর সন্তান ড.মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে ক্ষমা করে দেয় আমিরাত সরকার।

Discussion about this post