পদ্মার উপর দিয়ে চলাফেরা অনেকটা বাঘের পিঠে বসে শিকার করার সমান। বাংলাদেশের বাঙালি জাতি এমন সাহস দেখিয়ে ছাড়লো।

আজ পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ আমার অহংকার। এ আমার অলংকার। কারন আমি একজন বাঙালী। থাকি সূদুর সুইডেনে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু কছিু ঘটনার জন্য শুনতে হয় অনেক কথা। আজ যা শুনলাম তা হলো গৌরব গাঁথা। একবার ভেবে দেখুন তো বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু বানালে তার কত অংশ বিদেশীরা আগেই নিয়ে যেত। তাদের নিয়ে যাওয়ার টাকার সুদ আসল গুনতে গুণতে আমরা হয়ে যেতে পারতাম হয়তো শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া দেশের নাগরিক। শেখ হাসিনার সাহস ও মনোবলের পরিস্ফূটন ঘটায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু হয়েছে বাঙালীর। আর বাঙালী হিসেবে এ গৌরবের আমি একজন অংশীদার।
জঙ্গল পাহাড় পর্বত ভেঙ্গে অবিরামভাবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা। তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কখনও আমরা চেষ্টা করিনি। তার অত্যাচার অবিচার সহ্য করে নিজেদেরকে সামলে নিয়ে বসবাস করে চলছি। সে নদীর একূল ভেঙ্গেছে ওকূল গড়েছে। সে আমাদের স্থায়িত্বকে বার বার হরণ করেছে। সে আমাদের দিয়েছে প্রচুর। যে কথা আমরা ভুলিনি কোনদিন ভুলবও না।
পদ্মা অবশ্যই শক্তিশালী নদী। এতযুগ পর তার বুকে সেতু তৈরি করা হয়েছে। পদ্মার উপর দিয়ে চলাফেরা অনেকটা বাঘের পিঠে বসে শিকার করার সমান। বাংলাদেশের বাঙালি জাতি এমন সাহস দেখিয়ে ছাড়লো।
এ প্রসঙ্গে ৭ই জুন প্রথম আলো পত্রিকার নাগরিক সংবাদ দূরপর বাসে আমার কবিতা “ওগো সুন্দরী আমি তোমার কথা বলছি” প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আমি অনেক কথা তুলে ধরেছি। পদ্মা সেতু নিয়ে আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি। একই সাথে ইঙ্গিত দিয়েছি এটা যখন সম্ভব তখন বাকি সব সমস্যারও সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ। মানুষ জাতি স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা জীব ভুলে গেলে চলবে কি? গদ্যাকারে না লিখে কবিতার ভাষায় লিখেছি।
অনেকের ধারণা বিশ্বের কিছু উন্নত, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশ যেমন জার্মান, জাপান প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে হিংস্র জাতিগুলির মধ্যে দুটি। তারা মনে করে এই দেশ গুলোতে গণতন্ত্র রয়েছে কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় তারা গণতান্ত্রিক হোক এবং মার্কিন সেনা ঘাটি শৃঙ্খলের মাধ্যমে এই দেশ গুলোতে গণতন্ত্র অটুট রেখেছে।
আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে “আপনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য আকুল। আপনি কি জানেন কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই? সেই সাথে তাদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে যেমন: বাংলাদেশে ইউএস বেস নেই, তেমনি গণতন্ত্রও নেই! গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেইসাথে এটিকে রক্ষা করতে, আমাদের শীঘ্রই বঙ্গোপসাগরে একটি মার্কিন সেনা ঘাঁটি দরকার। এটা ছাড়া আমাদের দেশে গণতন্ত্র টেকসই হবে না। কারণ, ভারত হস্তক্ষেপ করবে, পাকিস্তান, চীন করবে ইত্যাদি।”
ইদানীং সবাই লক্ষ্য করছেন সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মত দেশও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বন্দি হতে চলেছে পাশের দেশ রাশিয়ার হুমকি-ধামকি থেকে রেহাই পেতে। জানিনা প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কি গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস করছে!
প্রতিবছরে কী পরিমাণ স্কুল শিক্ষার্থী হত্যা হচ্ছে সেখানে? বিশ্বের কোথায় তারা নাক গলাতে বাদ রেখেছে? তবে হ্যাঁ অন্যান্য দেশের তুলনায় হয়তো কিছুটা ভালো, তবে সেটা যথেষ্ট নয়।
আমি বাংলাদেশী এবং সুইডিশ সেক্ষেত্রে যেটা দুই দেশের মানুষের জন্য ভালো সেটা নিশ্চয় গোটা বিশ্বের জন্যও ভালো হবে বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সুইডেন সব সময় বিশ্বকে নিয়ে ভাবে, বিশ্বের মানুষের পাশে দাঁড়ায় বিপদে আপদে।
বাংলাদেশের যে সমস্যা আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে সেটা হচ্ছে দেশের সম্পদ লুটপাট করে যারা বিদেশে পাঠাচ্ছে এবং যারা এটাতে সক্রিয় অংশগ্রহণসহ সব রকম সাহায্য করছে। এটা বন্ধ করতেই হবে। দেশকে ভালো না লাগলে, দেশ ছাড়ো, সমস্যা নেই। কিন্তু দেশের বারোটা বাজিয়ে লুটপাট করে নিয়ে যারা চলে যাচ্ছে সেটা হতে দেওয়া যাবে না। সব সহ্য করা যেতে পারে তবে বেঈমান বা নেমকহারামদের সহ্য করা ঠিক হবে না। আমাকে এমনও প্রশ্ন করা হয়েছে, “আপনি জানেন কেন বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের পুতুল?” পুতুল কে না পছন্দ করে?! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছেন “সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”
বাংলাদেশ সত্যিই একটি পছন্দের জায়গা। তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেরই লোভ রয়েছে, লোভ নেই শুধু রাজাকারের বাচ্চাদের যারা দেশটাকে লুটপাট করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে, আমি তাদের ঘৃণা করি। এদেরকে এখন শায়েস্তা করতে হবে। তার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে কারণ আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমরা গর্বিত বাংলাদেশী নাগরিক হয়ে পৃথিবীর দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমাকে আরো প্রশ্ন করা হয়েছে আমি গণতন্ত্রের বাণী সারাক্ষণ লিখে চলেছি কই পেরেছি কী পরিবর্তন আনতে?
একটি গল্প মনে পড়ে গেল এ প্রশ্নের কারণে। গত কয়েক বছর আগের হবে, বাংলাদেশের র্যাব প্রশাসন জঙ্গলে ঢুকেছে হাতি ধরতে এ খবরে ভয়ে মহিষ দৌড়ে পালাচ্ছে। সিংহ মহিষকে বললো র্যাব তো হাতি ধরতে জঙ্গলে নেমেছে তুমি কেন দৌড়াচ্ছো? উত্তরে মহিষ বলেছিল আমি যে হাতি না সেটা প্রমাণিত হতে কমপক্ষে বিশ বছর লাগবে মানে ততদিন আমারে আটকে রাখবে প্রশাসন।
ঘটনাটি হাস্যকর ঠিকই তবুও ভাবনার বিষয়। দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের ক্ষমতাবান প্রশাসনকে সহজে জাগানো যাবে না, সময় লাগবে। কারণ তারা যেটা করার সেটাই করবে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। তারপর লক্ষ্য করুণ সব সমস্যার জন্য বৈদেশিক সাহায্য নেওয়া হয় শুধু প্রশাসন ছাড়া। চোখে ময়লা না ঢুকলে কী কেউ কখনও বলে চোখে সমস্যা?
যে প্রশাসন অন্যের চোখে ময়লা ঢুকলে অনুভব করতে শেখেনি সেই ব্যথা কী জ্বালা! সে প্রশাসন দেশের মানুষের দুঃখ কষ্ট বুঝবে বলে মনে হয়না!
যাইহোক পরিবর্তনে দরকার সময়ের, দেশ স্বাধীনের পঞ্চাশ বছর পর যেমন পদ্মা নদীর উপর সেতু তৈরি হয়েছে নিজেদের অর্থে, ভাবুন যদি এত টাকা সত্যি সত্যিই বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেতু করা হতো কী পরিমান সুদ-মূল সহ পরবর্তী প্রজন্মকে সেটা আজীবন কুলুর বলদের মত টানতে হতো! বাংলাদেশের মানুষ অতীতে প্রমান করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে আর এবার প্রমান করল বঙ্গবন্ধুকণ্যার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু করে।
আমার বিশ্বাস বাংলার মানুষ আস্তে আস্তে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হবে। সচেতন জাতি তখন অজুহাত নয় খুঁজবে সততা, খুঁজবে সমাধান, আমি সেদিনের আশায়।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ফাইজার, সুইডেন।

Discussion about this post