জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত অধিকাংশ ঘাটের খেয়া পারাপারে যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ১০ টাকার ভাড়া এখন ২০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রের দাবি, ডাঙ্গারচর ৯ নং এবং বিওসি ঘাট থেকে শুরু করে দক্ষিণের সব ঘাটে ২০ টাকা করে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় হচ্ছে। এছাড়াও ডাঙারচর ঘাট থেকে উত্তরের সব ঘাটে ১৫ টাকা করে পকেট কাটছে খাস কালেকশনকারীরা। বাংলা বাজার ও অভয়মিত্র, সদরঘাটে ১৫ টাকা করে নিচ্ছে। অথচ চসিক অনুমোদন দিয়েছেন ১০ টাকা ভাড়ার।
কিন্তু ঘাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা তৃতীয় পক্ষকে ঘাট তুলে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন। ফলে, চসিকের নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সিদ্ধান্ত না মেনে নগরীর সব ঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
তথ্য বলছে, চসিকের রাজস্ব শাখার এস্টেট অফিস প্রজ্ঞাপন দিয়ে সল্টগোলা ঘাটের ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেন-প্রতি যাত্রীর ভাড়া (যন্ত্র চালিত লাইফ বোটে) ১০ টাকা, রিজার্ভ ভাড়া ২২০ টাকা, আরোহীসহ ব্যক্তি গাড়ি ৪ টাকা, গরু বা মহিষ প্রতিটি ৪ টাকা, ভেঁড়া-ছাগল-কুকুর বা অন্যান্য জন্তু ১ টাকা ও প্রতি মণ বোঝা বা ইহার কম ভাড়া ৫০ পয়সা। অথচ চসিকের ২০ ঘাটে কেউ মানছে না এই আদেশ।
স্থানীয় লোকজন ও সাধারণ যাত্রীরা জানান, কর্ণফুলী থেকে শহর, শহর থেকে কর্ণফুলী প্রতিদিন অর্ধলাখো মানুষের জেলা শহরে যাতায়াত। জেলা শহরে যাওয়া–আসার জন্য নগরীর খেয়া পারাপার ঘাটগুলো ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু গত পহেলা বৈশাখ থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে মাতব্বর ঘাটে ৬/৮ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা করে ভাড়া আদায় করছেন। তেল শুক্কুরের লোকজন তিনটি ঘাটে আধিপাত্য বিস্তার করছেন। কানাঘুষাও রয়েছে চসিকের অসাধু এক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে তিনটি ঘাট ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি। এজন্য ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা আদায় করছেন। পাশাপাশি মালামাল পারাপারের জন্যও বাড়তি টাকা নিচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কর্ণফুলীর ডাঙারচর ঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, পুরাতন ব্রিজঘাট, ফিরিঙ্গিবাজার ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, সদরঘাট, কর্ণফুলী ঘাট, ১১ নম্বর মাতব্বর ঘাটে কোন ধরনের চসিক কতৃক ইজারা আদায়ের তালিকা টাঙানো হয়নি। এমনকি চসিক সুত্রে ঘাটের সাম্পান মাঝিরা জানান, এ বছর হাইকোর্টের আদেশে চসিকের কোন ঘাট ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। স্থগিত রয়েছে ঘাট ইজারা দেওয়া।
ফলে, গত ৩১ মার্চ চসিকের রাজস্ব শাখার এস্টেট বিভাগ সিটি কর্পোরেশন মালিকানাধীন হাট বাজার, ফেরিঘাট, নার্সারি, পার্কিং ও গণশৌচাগার সমূহের ১৪৩১ বাংলা সনে ইজারা না হওয়ায় কর্মচারীদের দ্বারা ঘাটের খাস কালেকশন, টোল ও মাশুল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে কর্মচারীরা বহিরাগত সিণ্ডিকেটের সাথে আঁতাত করে তৃতীয় পক্ষকে ঘাট দেখাশোনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এতেই নানা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ঘাটে বিশৃঙ্খলাও বলবৎ রয়েছে।
ফলে, সিণ্ডিকেটরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করায় প্রতিদিন ঘাটের লোকজনের সঙ্গে যাত্রীদের কথা-কাটাকাটি হচ্ছে। বিপাকে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
ভুক্তভোগী যাত্রী সালাহ উদ্দিন, রুবেল ও ফারহানা বেগম অভিযোগ করেন, খেয়া পারাপারের জন্য আগে জনপ্রতি ১০ টাকা করে আদায় করা হতো। কিন্তু এখন অভিনব কায়দায় যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে রহস্যজনক ভাবে চসিক ও কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন নীরব রয়েছেন।
ওদিকে, এমন সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা সরকারি অর্থ ইজারা লোভী সিন্ডিকেটকে সহায়তা করে খাস রাজস্ব আদায় কম দেখানোর সুযোগ তৈরি করছেন। যা রাজস্ব ফাঁকির কৌশল ছাড়া কিছু নয় বলে পাটনিজীবি একাধিক সমিতির দাবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন সমিতির নেতা বলেন, ‘চসিক ঘাটের বিষয়ে দুলাল নামে এক ব্যক্তি মেয়রের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা আদায় করছেন। যাকে তাকে ঘাট পাইয়ে দিচ্ছেন।’ এভাবেই কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারসাজিতে কয়েক বছর পরপর গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোর ইজারা মূল্য কমে যায় এবং সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়।
যদিও চসিক নীতিমালা অনুযায়ী ঘাট ইজারা কিংবা খাস আদায়ে সমবায় অধিদপ্তর কতৃক নিবন্ধিত স্থানীয় পাঠনীজীবি সমিতি কে ঘাট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু খাস আদায়ে পাঠনীজীবি সমিতিকে দুরে রাখা হচ্ছে।
সল্টগোলা ডাঙ্গারচর পাটনীজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাম্পান মাঝিরা সাম্পান চালিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে দুমুঠো ডাল-ভাত খেতে চাই। আমরা চাই কেউ আমাদের পেটে লাঁথি না বসায়। আমরা এই ঘাটের মাঝি, আমরা যাত্রী পারাপার করতে চাই।’
জুলধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল হক, শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ইসলাম আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সংবাদে জেনেছি কর্ণফুলীর পাওনা টাকা গুলো চসিক না দেওয়ায় দক্ষিণপাড়ের ঘাট গুলো সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শহর কুলের ঘাটগুলোতে উন্নয়ন কাজ হয়। কর্ণফুলীর সব ঘাটগুলো অবহেলিত। এখন আবার কোর্টের নির্দেশে ইজারা বন্ধ থাকায় তৃতীয় পক্ষের হাতে ঘাট দেওয়ায় যাত্রীদের ব্যাপক হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন নানা অভিযোগ পাচ্ছি। ১০ টাকার ভাড়া এখন ২০ টাকা কেন নিচ্ছে। তা দেখার দায়িত্ব চসিকের। সাধারণ জনগণকে যে হয়রানি করতেছে তা বন্ধ করতে হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কিছু পাটনিজীবি সমিতি মিলে হাইকোর্টে রিট করে স্টে অর্ডার করেছেন। যাতে ইজারা টেন্ডার বন্ধ থাকে। যার কারণে ঘাটগুলোর ইজারা বন্ধ। আমরা ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতেছি। শিগগিরই রিট শুনানি করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সহকারী এস্টেট অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব লোকজন ঘাটগুলো দেখাশোনা করতেছেন। ১০ টাকার বাহিরে ভাড়া নেবার কোন সুযোগ নেই।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য জানা যায়নি।’
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post