এনামুল হক কুষ্টিয়া: রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা পেয়ে নতুন গতিপথের সন্ধানে প্রমত্ত পদ্মার ভয়াল আগ্রাসনে ভাঙ্গছে পাড় বিপন্ন জনপদবাসী।
ইতোমধ্যে সরকারী বেসরকারী জনগুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো বিলীন হয়েছে পদ্মার গর্ভে। পদ্মার ডানপাড়স্থ কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া ও তালবাড়িয়া দুই ইউনিয়নের ৭কি:মি এলাকায় প্রবল ভাঙ্গনে কৃষিজমি, বাড়িঘর, স্কুল মাদ্রাসা বিলিন হয়েছে ইতোমধ্যে।
জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ভেঙ্গে পরেছে নদী গর্ভে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টিজেলার সাথে সংযুক্ত একমাত্র মহাসড়কটিও পাড়ে দাঁড়িয়ে চরম ঝুঁকিতে। এবছর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ ও ভেড়ামারা ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর দাবি অবিলম্বে এই ভাঙ্গন ঠেকাতে স্থায়ী তীররক্ষা বাঁধ নির্মান প্রকল্প বাস্তবায়নসহ মনুষ্যসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কথিত বিশেষজ্ঞদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে, পূনর্বাসন করতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে। সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছেন, এমুহুর্তে জরুরী কাজ বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। তবে নদীর পানি কমার সাথে সাথেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করবেন।
আক্রান্ত এলাকার সর্বস্ব খুইয়ে ক্ষুব্ধ আশ্রয়হীনরা কুষ্টিয়া-ঈশ^রদী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে ঘন্টাকাল ধরে। এসময় স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক আব্দুল মোনিন বলেন, ‘পদ্মার বাম তীরে মূল কইজের মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পোর্ট নির্মানে প্রায় ১কি:মি গ্রোয়েন নির্মান করলো।
এতোবড় একটা ঘটনা ঘটালো প্রকল্প কর্তৃপক্ষ অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা মন্ত্রনালয় থেকে কোন অনাপত্তিটাও নেয়নি তারা। আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডও এর বিরূপ ভয়াবহতা সম্পর্কে আগে থেকে আমাদের কিছুই জানায়নি। যাদের গোয়ার্তুমি, অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতায় শান্ত পদ্মার অশান্ত আগ্রাসনে অস্তিত্ব সংকটে আমাদের প্রিয় জনপদ, এবং সিমাহীন মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে তাদের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং পূনর্বাসনসহ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এলাকা রক্ষা করতে হবে।
মিরপুর উপজেলার সাহেব নগর গ্রামের প্রৌঢ়া সোমেলা খাতুন (৮১) বিলাপ করছিলেন, ‘আহ হা হা, সুনার সার ভুঁই, এক দাগে ১০ বিঘি ভুঁই আমার। উর বাপ দুনিয়াই তিন বিদায় হয়ে গেছে, তিনডি ছাওয়াল এই ভুই আমাক দিয়ে গিছিলি। একন সব শ্যাস কইরি দেচে গাংয়ে। একটু মাতা গুইজি দাড়ানির জাগাও নি, কোন যায়ে দাঁড়াবো আর খাবো কি ? ঘরে কিচ্চু বুলতি কিচ্চু নি, এক যা আচে তুমরা এইডাই ঠেকা দেও, বুলাক দিয়ে গাং বাদি দেও’।
ঘরহারা গৃহবধু রেখা খাতুন(৩৫) বিলাপ করে বলছেন, ‘জমি জায়গা যা ছিলো সবই গেছে। এখন মাথা গোঁজার জাগাডাও নি। সর্বশান্ত হয়ে আমার অবস্থাও এখন আশ্রয়হীণ ভাসমানদের দলে। পাকা বাধ না হলি এই ভাঙ্গন কোন ভাবেই ঠেকানি যাবি না’ এখন যে বালুর বস্তা দিয়ে ঠেকাতি চাচ্ছে, ইতে কোন কাজই হচ্ছেনা, সবই গভীর পানিত তলা যাচ্ছে’।
একেবারে পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মীর আব্দুল করীম ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আহসানুল হক খান চৌধুরী বলেন, ‘ভাঙ্গনটি এমন এক পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে যে, যে কোন মুহুর্তে আমার কলেজটি জাস্ট পাড়ের উপর থেকে কাত হয়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যাবে। চোখের সামনে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। কলেজটি নদী গর্ভে যাওয়া মাত্রই কুষ্টিয়া-ঈশ^রদী মহাসড়ক যেটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর বঙ্গের ২১টি জেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সড়ক সেটিও চলে যাবে। ইতোমধ্যে জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ধ্বসে গেছে নদীতে, এখন হয়ত অপেক্ষায় আছে মহাসড়কটিও’।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, ‘এখন পানি কমার সময় পদ্মার তীব্র ভাঙ্গন রোধে তাৎক্ষনিক জরুরী আপতকালীন কাজ হিসেবে বালিভর্তি জিওব্যাগ ফেলানো হচ্ছে যাতে করে জানামালের ক্ষতিরপরিমান যতটা সম্ভব কমানো যায়। তবে এর স্থায়ী সমাধান হবে আমাদের অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে’।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ দেশরূপান্তরকে জানান, ‘পদ্মার ডান তীরে ভাঙ্গন কবলিত ৯ কি:মি: এলাকায় স্থায়ী বাধ নির্মানে ১ হাজার ৪শ ৭২ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে অনুমোদন প্রাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ এই অর্থ বছরেই শুরু হবে বলে জানালেন এই প্রকৌশলী।
এহ/26/10/24/ দেশ তথ্য

Discussion about this post