মোঃ মামুন অর রশিদ
পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে বোঝার উপায় নেই মাটির নিচে কোথায় কী আছে। মাটির নিচের সম্পদ অনুসন্ধান করে বের করতে হয়। মাটির নিচের প্রাকৃতিক সম্পদের কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে, বেশির ভাগই অনাবিষ্কৃত। আবিষ্কৃত ভূগর্ভস্থ সম্পদই সভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায় গ্রানাইট খনিতে এসে বোঝার উপায় নেই মাটির নিচের কর্মযজ্ঞ এত ব্যাপক। মধ্যপাড়া গ্রানাইট খনি দেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ পাথর খনি। এই খনিতে পৃথিবীর অন্যতম ভূগর্ভস্থ আগ্নেয়শিলা রয়েছে, যা গ্রানাইট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড (এমজিএমসিএল) ভূগর্ভস্থ খনি হতে গ্রানাইট পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো নির্মাণ তথা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে খনি থেকে পাথর উৎপাদন হয়েছে মোট ৯ লাখ ৭১ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। সে হিসাবে মাসিক গড় উৎপাদন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন। চুক্তি অনুযায়ী মাসিক গড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমান মাসিক গড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন বেশি।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে খনি থেকে ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৩৩২ মেট্রিক টন পাথর উৎপাদন হয়েছে, যার মধ্যে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন বিক্রি করে সরকারের ১৯৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। ২০০৯ হতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মধ্যপাড়া খনি হতে ৪৬ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন পাথর উৎপাদন করা হয়েছে। যা বিক্রয় করে ১ হাজার ৬৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা আয় হয়েছে। সরকারি কোষাগারে ভ্যাট, ট্যাক্স, রয়্যালটি, খনি ইজারা ফি, লভ্যাংশসহ অন্যান্য খাতে ৩৩৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জমা প্রদান করা হয়েছে।
১ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্তির এই খনিতে ১৭৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন কঠিন শিলা মজুত রয়েছে। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্রানাইট রয়েছে প্রায় ৭০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ধারণা করা হয়, আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত এখান থেকে গ্রানাইট উত্তোলন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) কর্তৃক ১৯৭৪ সালে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকায় ভূগর্ভের ১২৮-১৩৬ মিটার গভীরতায় গ্রানাইট পাথর আবিষ্কৃত হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে গ্রানাইট উত্তোলনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য সমীক্ষা পরিচালিত হয়। সমীক্ষায় মধ্যপাড়ায় একটি ভূগর্ভস্থ খনি বাস্তবায়ন কারিগরি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে প্রতীয়মান হওয়ায় ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও উত্তর কোরীয় সরকারের মধ্যে অর্থনৈতিক, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে একটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ওই সমঝোতা স্মারকের ধারাবাহিকতায় মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পেট্রোবাংলা ও উত্তর কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কোরীয়া সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন কর্পোরেশন (নামনাম)-এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নামনাম ১৯৯৪ সাল হতে প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রতিদিন তিন শিফটে ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গ্রানাইট পাথর উত্তোলনের জন্য মধ্যপাড়া খনি ডিজাইন করা হয়। প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষে মেসার্স নামনাম ২০০৭ সালের ২৫শে মে খনিটি মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড (এমজিএমসিএল)-এর নিকট হস্তান্তর করে।
মধ্যপাড়া খনি বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার মেসার্স নামনাম কর্তৃক ২০০৭ সালে খনি হস্তান্তরের পর হতে আগস্ট ২০১৩ পর্যন্ত এমজিএমসিএল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খনির উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের ক্রমবর্ধনশীল ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে পাথরের ব্যবহার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় এমজিএমসিএল এবং জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)-এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ৬ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর এমজিএমসিএল এবং জিটিসি-এর সঙ্গে ৬ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে জিটিসি কর্তৃক ৮.৮৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রানাইট পাথর উৎপাদন ও ১৪টি নতুন স্টোপ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় খনির উৎপাদন ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গ্রানাইট পাথরে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাথরের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে খনি হতে পাথর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মধ্যপাড়া খনির সম্প্রসারণ ও পাথর উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা যাচাই বিষয়ক একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মধ্যপাড়া খনির দ্বিতীয় ফেজ উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। নতুন খনি উন্নয়ন করা সম্ভব হলে খনি দুটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে বার্ষিক ৪ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অর্থাৎ দৈনিক ১৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাথর উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যা বর্তমান দৈনিক উৎপাদনের চেয়ে ১১ হাজার মেট্রিক টন বেশি।
পৃথীবির বিভিন্ন স্থানে সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ থেকে পাথর সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু মধ্যপাড়া খনিতে ভূগর্ভস্থল থেকে গ্রানাইট উত্তোলন করা হয়। এ কারণে মধ্যপাড়ার পাথর শক্তিশালী ও গুণে-মানে উন্নত। নির্মাণ কাজে মধ্যপাড়া খনির পাথর ব্যবহার করলে সেটি টেকসই হবে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়বে।
বাংলাদেশের মোট পাথরের চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ সরবরাহ করে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড। চাহিদার বৃহৎ অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মধ্যপাড়া গ্রানাইট খনিতে বিপুল পরিমাণ গ্রানাইটের মজুত থাকায় এ খনিকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গ্রানাইট খনির সম্প্রসারণের মাধ্যমে পাথর উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা গেলে পাথর আমদানির উপর চাপ কমবে এবং দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর

Discussion about this post