আব্দুর রহমান ওরফে রমা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাক্তিগত সহকারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয় তখন সে ওই বাড়ির বারান্দায় শুয়েছিল। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রমা বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে শেখ কামালকে হত্যার মধ্যদিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। আর সর্বশেষে হত্যা করা হয় শিশু শেখ রাসেলকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতের প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহমান শেখ রমা ঊনসত্তর সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় যে মামলা করা হয় তাতে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সাক্ষী।
জবানবন্দিতে রমা বলেছিলেন, পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট রাতে যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে ছিলেন রমা সেই ঘরের বারান্দায় ছিলেন। ভোররাতের আগেই বঙ্গবন্ধু তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকান্ডের খবর পান। এরপর বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনো সাড়া শব্দ না পাননি মহিতুল।
ওই দিন ভোর রাতে বাড়িটির দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়। এরপর ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় আসেন। বেগম মুজিবের কথায় নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে আসি। দেখি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন।
আমি দোতলায় গিয়ে দেখি, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। তিনতলায় গিয়ে শেখ কামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায়। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ডেকে তুলি। তারা দ্রুত জামা-কাপড় পরে বেগম মুজিবের কক্ষে যান।
গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল ইসলাম। এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জকে বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’।
বঙ্গবন্ধুর কথা শেষ হওয়ার আগেই একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ বলেই বঙ্গবন্ধু উপরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। তখন কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল।
আব্দুর রহমান রমা আরো বলেন, নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল সাফায়েত জামিলকে পেয়ে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।”
পরে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।”
এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে উপরে চলে আসে। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
রামা বলেছিলেন, দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং তাকে নীচে আনা হয়। তখন রাসেল বলছিলো ‘ ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো ? মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন: ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না’। পরে রাসেল বলে, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো।’
পরে ‘ওই হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নীচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে: ‘স্যার, সব শেষ।’
এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে।
—-দৈনিক দেশতথ্যের জন্য লেখাটি পাঠিয়েছেন প্রখ্যাত আইনজীবি ও সাংবাদিক এডভোকেট আলী আসগর স্বপন। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা অফিস।
এবি/দৈনিক দেশতথ্য/০২ আগস্ট/২০২১।

Discussion about this post