পৃথিবীর পানিয় জল কাদামাটি নদনদী সবই প্রি মেইড। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার ধংশ নেই, আছে রূপান্তর। যেমন পানি জমে বরফ হয়। জল পুড়ে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে এক আকার থেকে আরেক আকার নেয়।
এভাবেই পূর্বনির্মিত গঠণ প্রণালীর উপর চলছে প্রকৃতি, প্রকৃতির বাসিন্দা, জড় ও জীব জগৎ। জগতের অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে মানব দেহের গঠন শৈলী এবং তাঁর চমৎকারিত্ব বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে মানুষের দেহে যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে তাইই আছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এমন কিছু নেই যার প্রয়োজন অনাবশ্যক।
প্রয়োজনের তাগিদে মূলকে ঠিক রেখে বাড়তি অংশ কেটে বা ছেঁটে দিলে সুবিধা বই অসুবিধা হয় না। কিন্তু মূল অংশে কিঞ্চিত অযাচিত হস্তক্ষেপ হলে বিপর্যয় অনিবার্য্য। যেমন পায়ের আঙ্গুলের নখ বা চাড়ার বাড়তি অংশের চেয়ে এক জাররা বেশি কাটলেই আঙ্গুল অরক্ষিত হয়ে যায়। অরক্ষিত অংশের জ্বালা এবং যন্ত্রনা পুরা মানব দেহকে অস্থির করে তোলে।
ঠিক একই ভাবে পাহাড়, নদী, গাছপালা, মাটি, সমুদ্র সমুহের উপর এবং নিচ সবই প্রকৃতির প্রয়োজনে সৃজিত। তাই বলে প্রকৃতি থেকে মানুষ যে কোন কিছু নিতে পারবেনা তা নয়। মানুষের যা প্রয়োজন প্রকৃতিতে থেকে মানুষ অবশ্যই তা সংগ্রহ করবে। যেমন গাভীর শরীরে যে দুধ আছে তার পুরাটাই বাছুরের জন্য। বাছুরের প্রয়োজন মিটিয়ে গৃহস্থ যদি তার পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু দুধ নেয় তাতে বাছুরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকেনা। এর বিপরীত হলে তা কখনই কারো জন্য মঙ্গল জনক হয়না।
প্রকৃতির নিয়ম কানুন উপেক্ষা করে প্রকৃতির প্রায় সকল সিষ্টেমের গায়েই মানুষ হাত দিয়ে ফেলেছে। যার ফলে প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে নানা রকমের বিপর্যয়। এসব বিপর্যয়ের প্রথম শিকার হচ্ছে মানুষ। মানুষ নিবিঘ্নে খাদ্য খেতে পারছেনা। গরুর মাংশে এনথ্রাক্স, হাস মুরগির মাংশে বার্ডফ্লু, মাছে ক্যান্সার দেখা দিয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ইতোমধ্যেই প্রাণীজ খাদ্য ছেড়ে দিয়েছেন।
উদ্ভিদজাত খাদ্যকে নিরাপদ মনে করে মাটির উপরের এবং নিচের ফল, পাতা ও মূলের দিকে ঝুকে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু না এখানেও নিরাপত্তা নেই। নির্ভেজাল ফল শশাতেও ধরা পড়েছে ই-কোলাই নামের মারাত্বক ভাইরাস। পানিতে দেখা দিয়েছে আর্সেনিক সহ নানা নামের নানা রোগের ক্ষতিকর সব উপাদান। যার ফলে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা দুধের চেয়েও বেশি দাম দিয়ে কিনে খাচ্ছে ক্যামিক্যাল দিয়ে তদীয় ভাষায় বিশুদ্ধ বোতলজাত পানি।
কিন্ত এমন তো কথা ছিল না। মাত্র দু’দশক আগেও আমরা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্নে পান করেছি খাল-বিল, পুকুর ও কূয়া কিংবা ইন্দ্রারার পানি। কালের বিবর্তনে পানীয় জলকে আরো নিরাপদ করতে খাওয়া শুরু হলো টিউবয়েলের পানি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল এসব পানিও বহন করছে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ। এসব যন্ত্রনা থেকে রক্ষা পেতে শুরু হয়েছে মিনারেল ওয়াটারের যুগ।
এরপর কি হবে তা সময় ছাড়া বোধ করি কেউই বলতে পারবেনা। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানুষের জীবনের আরাম আয়েশ বাড়লেও সার্বিক নিরাপত্তা ক্রমান্বয়েই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। গবেষকরা বলছেন, বিজ্ঞান এবং প্রকৃতি কখনই একে অপরের বিপরীত নয়। তাহলে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় কেন প্রকৃতির বিপর্যয় হচ্ছে তা এখন সার্বজনিন এক প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর যে বিজ্ঞানীদের জানা নেই তা নিশ্চয়ই নয়।
বিজ্ঞানীরা অবশ্যই সবই জানে এবং বোঝে। কিন্ত তাদের বেশির ভাগই নানা রকম উদ্ভাবন করে নাম খ্যাতি এবং যশ কেনায় উন্মত্ত হয়ে প্রকৃতির সর্বনাশ করে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংশ ডেকে আনছেন। এমন কথাই বিজ্ঞজনেরা বলছেন। যেমন মাটির নিচে যে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল সহ নানা ধরনের খনিজ পদার্থ আছে তার প্রায় সবই প্রকৃতির সার্ভিস সুষ্ঠু রাখার জন্য। কিন্ত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খনিজ পদার্থ সংগ্রহে রেখে নিজেদের আধিপথ্য বজায় রেখে একরাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রকে করায়াত্ত করতে গিয়ে প্রকৃতি ধ্বংশের মত আত্মঘাতি কাজ করে চলেছে।
জানা গেছে এক জার্মান বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন যে, সমুদ্রের তলদেশে মজুদ আছে বিপুল পরিমান হাইড্রোকার্বাইড নামের এক প্রকারের গ্যাস। এই গ্যাসের মজুদ নাকি মাটির নিচে সংরক্ষিত গ্যাসের চেয়ে অনেক অনেকগুন বেশি। এই গ্যাসকে রক্ষা করতে নিয়োজিত আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে বরফের আবরণ। এই আবরণ ভেদ করে ঢোকানো হবে পাইপ। সেই পাইপের একপ্রান্ত দিয়ে ঢোকানো হবে কার্বনড্রাইঅক্সাইড গ্যাস এবং এই গ্যাসের প্রেসার দিয়ে অন্ত প্রান্ত দিয়ে বের করে নেয়া হবে হাইড্রো কার্বাইড গ্যাস। এই গ্যাসের পরিবর্তে কার্বনড্রাই অক্সাইড গ্যাস সেখানে ঢোকানো হলে গলে যেতে পারে বলফের আবরণ। যার ফলে বেড়ে যেতে পারে পানির উচ্চতা কিংবা এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের প্রাণ ধারণ ক্ষমতা অথবা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে সমুদ্রের পানি। তাই যদি হয় তবে স্থলভাগ এবং জলভাগ দুইই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে।
বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার অহমিকায় মানুষ দখল করে নিয়েছে ভূগর্ভ, সাগরের নিচের অংশ, জলাংশ ও উপরিভাগ। সেখানে প্রতিনিয়ত চলছে জলযান। ভূমির উপরিভাগে বিরতিহীনভাবে চলছে নানা ধরণের হালকা ও ভারী যানবাহন। অন্তরীক্ষে চলছে বিমান। ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীর কোন অংশই পাচ্ছেনা অবসর। নদী ও সাগরে কৃত্রিম ঢেউ, ভূমিতে মাত্রারিক্ত কম্পন বাতাসে অতিরিক্ত চাপ।
যারফলে রুষ্ঠ প্রকৃতিতে এসেছে বৈশি^ক মহামারী করোনা। তার দাপড়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে জ্ঞান বিজ্ঞান। কোন কিছুতেই কেউ থামাতে পারছেনা করোনা মহামারী। জীবন বাঁচাতে প্রকৃতির কাছ থেকে দখল করা সব কিছু ছেড়ে দিতে হয়েছে। ক্ষমতাধর পরাশক্তির গোলাবারুদ কামান জোমান কোনটাই কাজে আসেনি। করোনার প্রকোপে বন্ধ হয়েছিল জলযান স্থলযান ও নভোযান।
করোনার শিক্ষায় মানুষ বুঝেছে প্রকৃতির রুদ্ররোষ কেবল ঝড় বৃষ্টি কিংবা জলোচ্ছ্বাসে নয় করোনার মতো অদৃশ্য ও নিরব ভাইরাসের মধ্যেও আসতে পারে। মানুষ সতর্ক না হলে মহা সর্বনাশ অবশ্যাম্ভী।
লেখক: জাতীয় পর্যায়ের সিনিয়র সাংবাদিক।

Discussion about this post