হেডিংয়ে লেখা দু’টি জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে হলে পড়তে হবে আজকের এই লেখা। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন সেই দিকে। আক্রমণকারী ভ্লাদিমির পুতিনের নাম সবাই জানে। জেলেনস্কির নাম সারা বিশ্বের আমজনতা আগে তেমন একটা জানতেনও না। এই সুবাদে তাকে নিয়ে দু‘টি কথা চর্চা করতেই আজ দৈনিক দেশতথ্যে এই কলামের অবতারণা করেছি।
ভ্লাদিমির পুতিনের ক্যারিয়ার অনেক অনেক বড়। জেলেনস্কির ক্যারিয়ার তেমন একটা বড় নয়। তিনি ছিলেন নাটক সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার। এরপর হয়েছিলেন অভিনেতা। তাও আবার নায়ক কিংবা ভিলেন নয়। তিনি ছিলেন একজন কৌতুক অভিনেতা।
সুইডেনে আমার চেনাজানা কয়েকজন ইউক্রান বন্ধু রয়েছে। তারা প্রায় সবাই জেলেনস্কির সমবয়সী। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা। যা জানলাম তা হলো এই যে, তাঁর বয়স মাত্র ৪৪ বছর। লেখা পড়া ও সৃষ্টিশীল কাজে তিনি খুবই ভালো।
তিনি তখন স্কুলের ছাত্র। সে সময়ে এক মন্ত্রী স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সবাইকে আরো মেধাবী হতে বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, অজানাকে জানতে হবে। জ্ঞানকে বিকশিত করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
জেলেনস্কি হাসতে হাসতে তাঁকে বলেছিলেন, মাননীয় মন্ত্রী আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে, আপনাদের কাজ তত কমবে। আমরা কম মেধাবী বলেইতো আপনারা আজ বড় বড় মন্ত্রী। অনেকেই অনেক সময় মনে মনে অনেক কিছুই ভাবে কিন্তু সাহস করে সবাই সবকিছু বলতে পারে না যা সে বলেছিল।তার সাহস দেখে অনেকে বলছেন ছেলেটি বড় হলে কিছু একটা হবে। সে জাতীকে হয়তো একদিন নতুন পথ দেখাবে। জেলেনস্কি বড় হয়ে ইউক্রানদের সেটাই দেখিয়েছেন।
তার কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। তারপর অভিনেতা কৌতুক অভিনেতা হিসাবে কাজ করেছেন। ছবির পরিচালনাও করেছেন। ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে ভাবনায় ঢুকেছে দেশের কথা। তিনি দেখেছেন বিভিন্ন পদে অযোগ্য মানুষে দেশটা ভরে আছে। এই চিন্তা থেকে রাজনীতিতে এসেছেন এবং সে ৬ষ্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট হয়ে শপথ নেয়ার অনুষ্ঠানে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নিজের যোগ্যতায় আমি প্রেসিডেন্ট হইনি। প্রেসিডেন্ট হয়েছি পূর্ববর্তী শাসকের অযোগ্যতায়। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন কথা বলেছেন। যেমন একজন প্রধান শিক্ষকের কাজ স্কুল পরিচালনা করা। একইভাবে আমারও কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
আমি মূর্তিও না, প্রতিমাও না, আইকনও না। সুতরাং আমার ছবি অফিসের দেয়ালে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। আপনজনের ছবি লাগান। মন ভালো থাকলে কাজেও আনন্দ পাবেন। আমি আমার অফিসে আমার শিশুর ছবি লাগাবো। আপনারাও আপনাদের অফিসে শিশুর ছবি লাগান। মাতা-পিতার ছবি লাগান। আর যেকোনো কাজ করার আগে তাদের দিকে একবার তাকান। এসব মানুষের ছবি সামনে রেখে কেউ কোনো বাজে কাজ করতে পারেনা। আপনার বাবা-মা যেমন আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। আপনারও শপথ হবে আপনার শিশুকে আপনি আরো সুন্দর জায়গায় পৌঁছে দিবেন। আমি একসময় ছবির পরিচালনা করেছিলাম। কিন্তু দেশতো আর ছবি নয়, তবে সবাই মিলে চাইলে আমরা দেশকে ছবির মতোই করতে পারি ইত্যাদি।
তার ব্যাপারে খবরের কাগজেও অনেক পড়েছি। গতকাল দেখলাম একটি ডকুমেন্টরি। সেই ডকুমেন্টারীতে দেখলাম, জেলেনস্কি ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে সংসদে ঢুকলেন। টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে ল্যাপটপ বের করলেন। তার আগে বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়ে এসেছিলেন যে পাত্রে সেটা বের করলেন। বোঁঝা গেল জনগণের টাকায় তার রাজকীয় লাঞ্চ হয়নি।
আরেক দিন হঠাৎ সংসদ ভবনে ঢুকে দেখেন তুমুল আকারে হাতাহাতি চলছে। কে শুনে কার কথা, জেলেনস্কি প্রথমেই বললেন প্লিজ থামুন কী হচ্ছে এসব? তার কথায় কেউই তেমন গুরুত্ব দিলেন না। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করছে। এবার তারা মারামারি ছেড়ে মুহূর্তের মধ্যে হতভম্ব হয়ে জেলেনস্কির দিকে তাকালেন। এবার জেলেনস্কি বললেন, সরি জোকস করছি মাত্র।
এভাবে হাসি তামাশার মধ্যদিয়ে কখনও সারকাস্টিকভাবে বড় বড় সমস্যার সমাধান করার পেছনে সম্ভবত তার অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা কাজ করেছে।বাকপটুতা ও জোকস বলে আর যাই হোক যুদ্ধে জেতা যায়না।
তবে ইউক্রেন সংকটে মোকাবেলায় জেলেনস্কিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছুটা ভিন্ন ধরণের নেতা। রাশিয়ার আকস্মিক আক্রমণ ইউক্রেনে বিশ্বের অনেক নেতার নেতৃত্বের ক্যাপাসিটি এবং ক্যাপাবিলিটি আমরা লক্ষ করছি। পুতিন যেমন গণসমাজ থেকে দূরে থেকে ডিজিটাল কমনিকেশন মেইনন্টেইন করে চলেছেন। আর জেলেনস্কি মিলিটারী ট্রেনিং না নিয়েই ফৈজি ডিক্টেটর পুতিনের বিরুদ্ধে লড়ছেন যুদ্ধের ময়দানে থেকে।
এযুগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতাকে যুদ্ধের ময়দানে ঘুরাঘুরি করতে খুব কমই দেখা যায়। যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ব্লাগিমির জেলেস্কিকে। তাঁকে নিয়ে ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে বেশ আলোচনা চলছে। যদিও এখনও বিশাল কিছু ঘটেনি যে তাঁকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে তবে যে আভাস তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠেছে তাতে করে প্রকৃতির সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়।
জেলেনস্কিকে সব ধরণের নিরাপত্তা দিতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে আমেরিকার নাম এসেছে কারণ বিষয়টিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে দেখছেন। কারো ধারনা পুতিনের মেইন টারগেট ইউক্রনের বর্তমান প্রশাসন ধ্বংস করা। সে ক্ষেত্রে জেলেনস্কিকে নিরাপত্তা দিতে বিশ্বের অন্যান্য নেতাদের দায়িত্ব রয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পাকিস্তান সরকার ভেবেছিল শেখ মুজিবকে আটকে দিলেই সব আন্দোলন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কিন্ত বাস্তবে যে, তা হয়নি একথা বিশ্ববাসি জানে। ঠিক এমনিভাবেই পুতিন হয়তো ভাবছে জেলেনস্কিকে ধরতে পারলেই সব তার হাতের নাগালে আসবে। অভিজ্ঞতা বলে একথা ঠিক নয়।পাকিস্তানীরা যেভাবে বাঙালীদের আটকে রাখতে পারেনি ঠিক সে ভাবেই ইউক্রেনিয়ানদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ভ্লাদিমির পুতিন। হতে পারে বেসামরিক জেলেনস্কির কাছে হেরে যাবেন সামরিক একনায়ক পুতিন।
সে যাইহোক হোক না কেন, আমরা অতি সত্ত্বর ইউক্রেন তথা পুরো ইউরোপে শান্তি ফিরে পেতে চাই। ফিরে পেতে চাই একটি সুন্দর পৃথিবী। যেখানে হিটলার, আইয়ুব খান, পুতিন, কিম বা বার বার স্বৈরাচারির রাজত্ব নয়। আমরা দেখতে চাই আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন মান্ডেলা, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, ওলফ পালমে, এঞ্জলা মার্কেল এবং এযুগের নতুন নেতা জেলেনস্কির মতো দেশপ্রেমিক নেতাদের। যারা মানুষের কথা ভাবে, গোটা বিশ্বের কথা ভাবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
গ্রাফিক্স ও সম্পাদনায় আব্দুল বারী//দৈনিক দেশতথ্য/মার্চ ৬,২০২২//

Discussion about this post