সময়ের সাথে তাল রেখে বদলে যাচ্ছে সবই। যে না বদলাবে সে পিছে পড়ে যাবে। জনসংখ্যার হিসেবে আগের দিনে ঢাকার অবস্থান যথার্থই ছিল। আজকের দিনে ঢাকাকে ফাঁকা না করলে ব্যাল্যান্স বা ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি প্রকৃতির রুদ্র রোষে ধ্বংশ হয়ে যেতে পারে ঢাকার অস্তিত্ব। কিভাবে পারে তা বলার আগে আমার একটি অনুভূতির প্রকাশ দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করতে চায়।
সে অনেক দিন আগের কথা। খন্দকার ফারুক আহমেদ ও শাম্মী আকতারের কন্ঠে “ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে” গানটি শুনেছিলাম। এরপর মাগুরা জেলার একটি গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসেছিলাম। সেই ঢাকা আর আজকের ঢাকা এক নয়। একই ভাবে সেই দিনের আমি আর আজকের আমি এক নয়। সেদিনে গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসে যে উত্তেজনা ও অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা আজ অন্য রকম।
তার কারন হলো এই যে, আমি এখন বিশ্বের এক উন্নত একটি দেশে বাস করি। সেই দেশে শব্দ দুষণ, ট্রাফিক জ্যাম, ঘনবসতিপূর্ণ জীবন বা দুর্নীতির কোনো বালাই নেই। সাগরের পাড়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিসে আছি প্রায় চল্লিশ বছর। তারপরও আমার জন্মভূমি সোনার বাংলাকে আমি সুন্দর পরিকাঠামো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে চাই।
বলতে পারেন একটি উন্নত দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা কিভাবে হয়। নিশ্চয়ই হয়। কারন কোন দেশই একদিনে উন্নত হয়নি। যারা সময়ের সাথে তাল রেখে নিজে বদলেছে এব্ং দেশকে বদলেছে তারা প্রায় সবাই সফলতা পেয়েছে। সফলতার প্রথম শর্ত হলো নিয়ম মেনে চলা। নিয়ম না মনলেই ঘটে ডেভিয়েশন বা চ্যুতি। আর এই ডেভিয়েশনের কারণে সৃষ্টি হয় উচ্ছৃঙ্খলতা এবং দুষিত পরিবেশ। বাংলাদেশে এই চ্যুতির মাত্রা অনেক বেশি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এর সীমা ছাড়িয়ে চলেছে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে “ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে ঢাকা”। এর সবচেয়ে বড় প্রমান হলো বাংলাদেশে ট্রাফিক ব্যবস্থা। অনেক গুলো ফ্লাই ওভার করেও যানজট কমানো যাচ্ছেনা। মেট্রো রেল চালু হলে এর সমাধান হবে তাও মানা যাচ্ছেনা। এর প্রধান কারন হলো আইন না মানার প্রবনতা। নিয়ম না মানার কারণে কয়েক বছর আগে ঢাকায় শুরু হয়েছিল স্টুডেন্ট ঝড়। স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ট্রাফিক ম্যনেজমেন্টর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সবার ভুল ত্রুটি। এরপর দুই তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই অবস্থা হয়েছে তথৈইবচ।
ঈদুল আযহার আগমনে বাড়ী ফেরার টানে নিয়ম ভাঙ্গায় প্রতি বছর ঘটে অনেক বড় বড় ঘটনা। বিশ্বের উন্নত দেশে ট্রেন বা বাসের ছাদে ভ্রমণের রেওয়াজ নেই। কিন্ত বাংলাদেশে এই দৃশ্য আকচার। এরও মুল কারন হলো ব্যালেন্স না রাখতে পারা। চাহিদা ব্যালেন্স করে যানবাহন রাখলে সুষ্ঠ ট্রাফিক ব্যবস্থা বজায় রাখা সম্ভব।
এসব না করে সরকার যানবাহন মালিক ও জনগণের বড় একটি অংশ সব নিয়ম কানুন জলাঞ্জলি দিয়ে যার যা খুশি তাই করছে। যেমন নৌ-বাহিনীর হেড কোয়াটার, বনজ সম্পদের হেড কোয়াটার, কবরস্থানের হেড কোয়াটার কেন ঢাকাতেই থাকতে হবে? আর কেনই বা সবাই ঢাকার দিকে ছুটে আসবে। এ থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে কেবলমাত্র ট্রাফিক নয় সর্বক্ষেত্রে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকাকে ফাঁকা করতে হবে।
ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে ৬৪টি জেলার ভূমি ও অবকাঠামোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা খুবই প্রয়োজন। এখন বিজ্ঞানের যুগ। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। এই যুগে সবকিছু এক জায়গায় রাখার কি প্রয়োজন ? এ সব সমস্যা দূর করতে হলে শর্ট এবং লং টার্ম পরিকল্পনার নিয়ে এগুতে হবে। যেকোনো অবস্থাতেই ঢাকায় বসবাস করতে হবে এ মনমানসিকতা দূর করতে হলে প্রথমে যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো : কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নানা শিল্প-কারখানা এবং ঢাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য এসেনশিয়াল সংস্থা গুলো রেখে অন্য সব সংস্থা ও বিভিন্ন বাহিনীর হেডকোয়াটার ঢাকা থেকে সরাতে হবে। ঢাকা শহরের ভেতরে শিল্প, ব্যবসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকা শহরকে পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। জেলা শহরগুলোয় ঢাকার মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার। এতে অন্য শহরগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। দ্বিতীয় সারির শহরগুলো উন্নত হবে। সমগ্র গ্রাম এলাকায় কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।
সে যাই হোকনা কেন, যেমন চলছে আগামীতেও তেমনই চলবে এই মতবাদ আঁকড়ে পড়ে থাকলে বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা যাবেনা। বাংলাকে কোটি কোটি মানুষের অভিশাপের বাংলা, দুর্নীতির বাংলা, অন্যায় অত্যাচারের বাংলা করা ঠিক হবেনা।
ঋণমুক্ত, অভাবমুক্ত ও সোনার বাংলা পেতে হলে আগে মানবতা ও মনুষ্যত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার। এর জন্য সবার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের ভারসাম্য বা ব্যাল্যান্স নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না।
বর্তমানে বিশ্বের সভ্য জগতে চলছে ধ্বংসাত্মক অ্যাক্টিভিটিজ। যার ফলে ইউক্রেন হারাতে বসেছে তার হেরিটেজ। অন্য দিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ধ্বংসাত্মক ক্ষতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ অস্ট্রেলিয়ার সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টিপাত। যদি প্রকৃতি হঠাৎ করে বাংলাদেশ তথা রাজধানীকে ছোবল মারে তবে ঢাকাকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে আর দেরি নয় দেশকে, দেশের রাজধানীকে প্রকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে প্রোঅ্যাক্টিভ পদক্ষেপ এবং ক্রিয়েটিভ পদ্ধতির ব্যবহারই একমাত্র সমাধান।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ঝুড়ির ১৮টি আমের মধ্যে একটিতে পচন ধরেছে। বাকি ১৭টি শত চেষ্টা করলেও পচাটিকে ভালো করতে পারবে না। তবে পচাটি অন্য ১৭টি আমকে পচিয়ে দিতে পারবে। ঠিক একইভাবে দেশের পরিকাঠামো যদি দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট গ্রুপের কারণে সঠিক পরিকল্পনা থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তাকে এখনই নিয়ন্ত্রণনে আনতে হবে।
এর মানে হলো এই যে, ১৭ কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির রুদ্র রোষ থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে অবিলম্বে বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করতে হবে। এই কাজটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততোই সেটা করতে পারা শ্রেয়।
যারা এসবের দায়িত্বে আছেন তারা ঢাকাকে রক্ষার সঠিক পদক্ষেপ এখনই নেন। আমরা যেন ঢাকা এয়ার পোর্ট নেমেই গাইতে পারি খন্দকার ফারুক আহমেদ ও শাম্মী আকতারের সেই গান “ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে”। ঢাকাকে আমরা উন্নত বিশ্বের রাজধানীর মতো না পেলেও আমাদের মতো করে পেতে চাই। সেটা হবে কিনা তা কেবল তারাই বলতে পারে যারা এসবের দায়িত্বে আছেন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

Discussion about this post